বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৭ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম:
সিপাহী বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে মুলাদীর সোনামদ্দিন বন্দরে বিএনপির আলোচনা সভা মুলাদীর চর বাটামারা জমির দখল পাচ্ছে না খোরশেদা আক্তার ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ২০২৪ এর পুনর্জন্ম : উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনের সাথে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সাক্ষাৎ মিথ্যা মামলার হয়রানি থেকে মুক্তি চায় আলি আকবার পরিবারবর্গ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে : উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অর্ন্তবর্তী সরকারের অন্যতম কাজ শহীদ পরিবারকে সহায়তা ও আহতদের পরিপূর্ন চিকিৎসা : মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা আবারো এলডিপির যুগ্ম মহাসচিব হলেন সালাহ উদ্দীন রাজ্জাক যৌথ অভিযানে ভোলায় অস্ত্রসহ দুই ডাকাত আটক নারীর প্রতি সহিংসতা সামজিক ব্যাধি দুর করতে হবে : উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ

অদক্ষ প্রশিক্ষকের হাতে তৈরি হচ্ছে অদক্ষ চালক

# রাজধানীতে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে অনুমোদনহীন ড্রাইভিং স্কুল
# ড্রেনের উপর এ-টু-জেড ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টার আতংকে পথচারী
# নেই দক্ষ প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণের মাঠ গড়ে উঠেছে লাইসেন্স যোগাড়ের স্কুল

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীতে অনুমোদন ছাড়াই অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ড্রাইভিং স্কুল। অনুমোদন না থাকলেও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ভালোই চলছে এসব ড্রাইভিং স্কুলের কার্যক্রম। ব্যাঙের ছাতার মতো রাজধানীর উত্তরাসহ যত্র-তত্র গড়ে উঠা এসব ইনস্টিটিউশনে না আছে অনুমোদিত প্রশিক্ষক, না আছে প্রশিক্ষণের জায়গা।

সারাদেশে ১৪৭টি বিআরটিএর নিবন্ধিত ড্রাইভিং স্কুলের মধ্যে রাজধানীর উত্তরাতেই অনুমোদিত (বৈধ) ৬টি ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুল রয়েছে।

তবে অনুসন্ধানে দেখা যায় উত্তরাতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, ফুটপাতের ড্রেনের উপর টংক (বাক্স) বানিয়ে তার সামনে ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুল সাইন বোর্ড লাগিয়ে ড্রাইভিং শেখানোর নামে প্রতারণা করে আসছে।

অভিযোগ রয়েছে, উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৪ নম্বর রোডের মাথায় ফুটপাতের ওয়াসার ড্রেনের উপর গড়ে উঠেছে এ-টু-জেড নামের একটি অবৈধ ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টার।

অভিযোগের ভিত্তিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ড্রেনের উপর স্থাপিত এ-টু-জেড নামের ওই ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টারের প্রশিক্ষণের জন্য নেই কোন মাঠ এবং হাতে-কলমে শেখানোর জন্য ক্লাসরুমের বালাই নেই। সেখোনে নেই কোন দক্ষ প্রশিক্ষক। তবে কাজীর গরু মতো। কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। বিআরটিএ-এর নিয়মের মধ্যে না পড়লেও বিআরটিএ-এর বৈধ লাইন্সেস পেতে মরিয়া হয়ে উঠে এ-টু-জেড নামের ওই ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টারের কর্তৃপক্ষ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিআরটিএ-এর এক অসাধু কর্মকর্তার সাথে গোপনে এ-টু-জেড নামের ওই ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টারের কর্তৃপক্ষ অলিখিত চুক্তির ভিত্তিতে বিআরটিএ-এর বৈধ লাইন্সেস পাওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আরো জানা যায়, উত্তরাতে প্রায় অর্ধশতাধিক ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুলের নেই কোনো বৈধ কাগজ পত্র, নেই টেইনারদের ট্রেনিং সার্টিফিকেট।

হাতেকলমে যারা গাড়ি চালানোর নিয়ম-কানুন শেখাবেন, তারাই মানছেন না নিয়ম। তাদের নেই প্রয়োজনীয় মাঠ ও সনদপ্রাপ্ত দক্ষ ইন্সট্রাক্টর (প্রশিক্ষক)। তাই তৈরি হচ্ছে অদক্ষ চালক। অথচ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) অনুমোদিত ড্রাইভিং স্কুলগুলোর ব্যানারে একাধিক ট্রেনিং সেন্টার খুলছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

জানা গেছে, দক্ষ ড্রাইভার তৈরির জন্য ট্রেনিং সেন্টার খোলার পূর্বশর্ত হচ্ছে, প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য নিজস্ব মাঠ থাকা। থাকতে হবে বিআরটিএর তালিকাভুক্ত ইন্সট্রাক্টর। কিন্তু বিআরটিএর তালিকাভুক্ত অধিকাংশ ড্রাইভিং স্কুলেরই তা নেই। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল অন্যের জমি নিজেদের প্রশিক্ষণ মাঠ বলে কাগজপত্র জমা দিয়ে লাইসেন্স নিচ্ছেন। এছাড়া অনুমোদন নেয়ার সময় যে যেসব ইন্সট্রাক্টরের লাইসেন্স জমা দেওয়া হয়ে থাকে। তিনি থাকেন না প্রশিক্ষণের দায়িত্বে।

এছাড়াও রাজধানীর ব্যস্ত সড়কেই অনেক প্রতিষ্ঠানকে প্রশিক্ষণ দিতে দেখা যায়। ওইসব গাড়ির চালক প্রশিক্ষণার্থী হওয়ায় যে কোনো সময় দুর্ঘটনায় কবলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটেও যায়।

মূলত ড্রাইভিং স্কুলগুলো অদক্ষ ড্রাইভাদের সঠিক প্রশিক্ষণ না দিয়ে বিআরটিএর অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে টাকার বিনিময় লাইসেন্স করে দেয়ার কাজে সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে তৈরি হচ্ছে অদক্ষ ড্রাইভার। আর তাই গত ১০ বছরে কেবল সড়ক দুর্ঘটনায় ঝড়ে গেছে হাজার হাজার নিরীহ প্রাণ।

জানা গেছে, গত ৭ আগস্ট পর্যন্ত দক্ষ ড্রাইভার তৈরির জন্য সারাদেশে বিআরটিএর নিবন্ধিত ড্রাইভিং স্কুল রয়েছে ১৪৭টি। এসব স্কুলে প্রশিক্ষণের জন্য বিআরটিএর তালিকাভুক্ত ইন্সট্রাক্টর রয়েছে প্রায় দুইশতাধিকের বেশি। আর বিআরটিএর হিসাব মতে, সারাদেশে নিবন্ধিত যানবাহন হচ্ছে ৫০ লাখের উপরে। সে তুলনায় ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্য খুবই কম। এ বিপুল সংখ্যক গাড়ি চালানোর জন্য দেড়গুণের বেশি চালক থাকার কথা। বর্তমানে দেশ ও বিদেশে চাকরির বাজারে ড্রাইভারদের কদরও রয়েছে বেশ ভালোই। নিয়ম মেনে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ চালক তৈরির পর্যাপ্ত স্কুল নেই। অথচ পেশাদার ও অপেশাদার চালক হয়ে রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হতে হলে অবশ্যই সবার আগে থাকতে হবে বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স।

আর এ লাইসেন্সের রয়েছে শিক্ষানবিশ, পেশাদার, অপেশাদার, পিএসভি ও ইনস্ট্রাক্টর- এই পাঁচ প্রকারভেদ। তবে শিক্ষানবিশ, পেশাদার ও অপেশাদার লাইসেন্সই বেশি প্রচলিত। এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিআরটিএ দায় এড়িয়ে গেলেও যাত্রীরা বলছেন, অদক্ষদের ‘চালক’ বানিয়ে দেওয়ায় সড়কে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আরো কঠোর হওয়া জরুরি বলে মনে সচেতন মহল।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ব্যাঙের ছাতার মতো রাজধানীর যত্রতত্র গড়ে উঠেছে নানা ধরনের ড্রাইভিং স্কুল। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কিংবা ওভার ব্রিজে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করছে তারা। সেখানে নারীদের জন্যে নারী প্রশিক্ষকসহ ড্রাইভিং লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

এদিকে, উত্তরার দিয়াবাড়ি বিআরটিএ চলছে দূর্নীতির মহা উৎসব। ড্রাইভিং লাইন্সেস পেতে দিয়াবাড়ি বিআরটিএ-এতে পরীক্ষা দিতে আসা নাম না বলা শর্তে এক পরীক্ষার্থী জানান গাড়ি ভাড়ার নামে নেওয়া হয় ২০০ টাকা। খোজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে পরীক্ষায় অংশ নেন শতাধিক পরীক্ষার্থী। শুধু গাড়ী ভাড়া বাবদ আসে ২০/৩০ হাজার টাকা। আর ওই গাড়ি ভাড়া বাবদ দেওয়া হয় মাত্র ৩ হাজার টাকা। আর বাকি টাকা হয়ে যায় পকেস্থ।

এছাড়াও পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়া, বিভিন্ন টেবিলে পাশ নাম্বার পাইয়ে দেওয়া এবং ফিঙ্গারের তারিখ ফেলানোসহ নানা অজুহাতে হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা। আর এসব ঘাটে ঘাটে টাকা না দিলেই ফেল করিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার অনেকে হয়রানির শিকার হতে বাঁচতে দালালের দিয়ে চুক্তির মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়ার অহরহ অভিযোগ রয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে বিআরটিএ-এর এক পরিচালক (প্রকৌশল ) বলেন, ‘এ ধরনের স্কুলের সর্ম্পকে অভিযোগ এলে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এমনকি ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা করাসহ প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেন।’

বাসাবো এলাকার বাসিন্দা আবদুল হাই নামে এক যাত্রী বলেন, কম সময়ে ড্রাইভিং শেখানোর পাশাপাশি দ্রুত লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে প্রশিক্ষার্থী নেয় এসব প্রতিষ্ঠান। আর এভাবে অদক্ষ চালকরা রাস্তায় গিয়ে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চলে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই এসব ইনিস্টিটিউট মালিকরা প্রশিক্ষণের নামে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সরকারি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট বাড়ানোর পাশাপাশি এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘একটা গাড়ি রাখার পর্যন্ত জায়গা নেই অথচ একটি ছোট ঘরে কিছু সাইনিং সিগন্যাল দিয়ে লিখে রাখা হয়েছে ড্রাইভিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। এগুলো দিয়ে একটা প্রকৃত চালক বের করা দুঃস্বাধ্য।’

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা এসব ড্রাইভিং স্কুলের বেশির ভাগেরই নেই ব্যবসায়িক বা প্রাতিষ্ঠানিক লাইসেন্স। প্রশিক্ষকের নেই প্রশিক্ষণ সনদ। অনেক জায়গায় আবার একজন সনদপ্রাপ্ত প্রশিক্ষকের বিপরীতে ৪-৫ জন অদক্ষ ও সনদহীন প্রশিক্ষক দিয়ে গাড়ি চালানো শেখানো হচ্ছে। প্রশিক্ষণ দেয়ার নামে নেয়া হচ্ছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা।

এ ব্যাপারে নিরাপদ সড়ক চাই-এর এক নেতা জানান, বাংলাদেশের বেশিরভাগ চালকই অদক্ষ। তাদের যেমন তাত্তি¡ক জ্ঞানের অভাব রয়েছে, তেমনি গাড়ি চালানোর দক্ষতারও অভাব রয়েছে। শুধু গাড়ি চালানো শিখলেই দক্ষ চালক হবে, এটা আশা করা যায় না। দক্ষ চালক হতে হলে ড্রাইভিংয়ের পাশাপাশি গাড়ি সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হবে। এজন্য হাতেকলমে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ড্রাইভিং স্কুলে প্রশিক্ষণ নিতে হবে।

রাজধানীর বিভিন্ন অনুমোদিত ও অননুমোদিত ড্রাইভিং স্কুল ঘুরে দেখা গেছে, এসব স্কুলে ভর্তি হলে প্রশিক্ষণ যা-ই হোক না কেন স্কুলগুলোই ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দেয়। অবশ্য এব্যাপারে তারা সরাসরি একথা স্বীকার করে না।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যেখানে একটা গাড়ি রাখার জায়গা পর্যন্ত নেই, অথচ সেই ছোট ঘরে কিছু সাইনিং সিগন্যাল দিয়ে লিখে রেখেছে ড্রাইভিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। এগুলো দিয়ে একটা প্রকৃত চালক বের করা দুঃস্বাধ্য।’ দায় এড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিআরটিএ বলছে, তদারকি রয়েছে তাদের।
বিআরটিএর এক পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) নাম না বলা শর্তে জানান, এ ধরনের স্কুল সম্পর্কে অভিযোগ এলে তাদের ম্যাজিস্ট্রেট যান সেখানে। মামলা করে তারপর জেল-জরিমানা বা ফাইন যা করার দরকার আইন অনুযায়ী তা করেন।

উত্তরা বিআরটিএ-এর লাইসেন্স শাখার সহকারি পরিচালক মোঃ ইমরান হোসেনের সাথে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2017 ithostseba.com
Design & Developed BY Hostitbd.Com
Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com